আহমদ ছফার 'বাঙালি মুসলমানের মন' ও বর্তমানের ফরহাদ মজহার 

  মোশাররফ হোসেন মুসা

০৪ মে ২০২৪, ১৩:০৭ | অনলাইন সংস্করণ

মোশাররফ হোসেন মুসা
একটি বই পড়ে মনে রাখার সহজ উপায় হলো সারসংক্ষেপ লিখে ফেলা( এটি জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের পরামর্শ  )।  ইদানিং বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সলিমুল্লা খান আহমদ ছফার ' বাঙালি মুসলমানের মন' নামক গ্রন্থটির উদাহরণ দিচ্ছেন বেশি। সেজন্য বইটি নতুনভাবে পড়লাম।  বইটি ১২/১৩ টি প্রবন্ধের সংকলন।  প্রবন্ধগুলো সম্ভবত  ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত লেখা। তার মধ্যে একটি প্রবন্ধের নাম বাঙালি মুসলমানের মন। 

এক. লেখক ভূমিকায় বলেছেন- যে জাতি উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন এবং সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না, অথবা সেগুলোকে উপযুক্ত মুল্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না, তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র গঠনও সম্ভব নয়( কথাটি মুল্যবান। কিন্তু এ কথার  সাথে বহু সাংঘর্ষিক কথা আছে)। 

দুই. একদিন প্রাতঃভ্রমণ কালে জিয়াউর রহমানের শিক্ষা উপদেষ্টা  আবুল ফজলের মাথায় টুপি দেখে তিনি বিস্মিত হন; যেহেতু আবুল ফজল ছিলেন আপাদমস্তক নাস্তিক। সরকারের সুনজরে থাকার জন্য তাঁর এরকম লেবাস পরিবর্তন  দেখে তিনি কষ্ট পান। 

তিন. আওয়ামী লীগের পরিচয় দেন এভাবে -  আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ভাসানী ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট। হোসেন সোহরাওয়ার্দী ছিলেন  নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। সুতরাং আওয়ামী লীগ হলো মুসলিম লীগের অংশ। সেকারণে তারা  পাকিস্তানের সাথে বাস করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সুচনা করতে পেরেছিলেন। তাঁর কথার সূত্র ধরে বলা যায়, স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের একটি অংশ গঠন করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ। জাসদ ভেঙ্গে হয় বাসদ। তাহলে জাসদ ও বাসদ হলো আওয়ামী ছাত্রলীগের অংশ। 

চার. সকলের জানা রয়েছে আওয়ামীলীগ হলো সামন্ত অবশেষের দল। আশা করা হয়েছিল  মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্ক থেকে সামন্ত অবশেষের ভাইরাস দূর হয়ে যাবে । সেটা দূর না হওয়ায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী মহলের মুখে  বহু অভিযোগ শোনা যায় । তারপরেও মন্দের ভালো আওয়ামী লীগ। তিনি এক জায়গায় বলেছেন-  'মুশকিলের কথা হলো আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন মুষ্টিমেয় নেতা বা নেত্রীর বিজয় সুচিত হয়।  কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন পরাজিত হয় গোটা বাংলাদেশটাই  পরাজিত হয়'। 

পাঁচ. বাঙালি মুসলমানেরা ছিলেন মুলত প্রান্তিক কৃষিজীবী। তারা  প্রথমে  বৌদিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিল, পরে উচ্চবর্ণের অত্যাচাড়ে  বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে।  তারপরে গ্রহণ করে  মুসলমান ধর্ম।  তাদের সঙ্গে  শাসক শ্রেণীর কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারা পায়নি রাজানুকল্য।  রাজকর্মচারী হতেন উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা। সেজন্য তাদের মধ্যে হীনমন্যতা কাজ করতো। ফলে পুঁথি লিখে তারা প্রতিশোধ নিতেন। ফলে তাদের মনোজগতে এদেশের সংস্কৃতির জায়গায়  আরবের কল্পিত সংস্কৃতি জায়গা  করে নেয়। শহীদে কারবালা, জঙ্গনামা, জয়গুন নামা,সোনাভান  ইত্যাদি পুঁথি কাব্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন- কারবালার যুদ্ধে  হযরতের দৌহিত্র হোসেনের মস্তক বিচ্ছিন্ন করে সীমার দামেস্ক অভিমুখে এয়াজিদের কাছে যাওয়ার জন্য ঘোড়া ছুটিয়েছেন। পথিমধ্যে রাত হয়ে গেলে তিনি 'আজর' নামে এক ব্রাহ্মনের বাড়িতে উঠেন৷ রাতে ছিন্ন মস্তকের মুখে কথা শুনে আজর ও তার স্ত্রী এবং তাদের সাত পুত্র মুসলমান হয়ে যান। এটা ছয়'শ বছর পরেও আলোকিত সময়ে মীর মশাররফ হোসেন তাঁর বিষাদ সিন্ধুতে অবিকল চেহারায় কাহিনিটি রেখে দেন( প্রশ্ন হলো ভারতের ব্রাহ্মণরা মরু অঞ্চলে গেল কীভাবে?)  অথচ সমসাময়িক সময়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ' মেঘনাদ বধ ' কাব্য লিখে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মনোজগতে কঠোর আঘাত হানেন। 

ছয়. তিনি লিখেছেন- জঙ্গনামাতে হযরত আলীকে দিয়ে শত শত বেদ্বীন কাফেরকে হত্যা করা হয়েছে। আমির হামজা যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে যাচ্ছেন এবং পরাস্ত কাফেরদের সুন্দরী রমণীদের পাণী পীড়ন করে চলেছেন তো চলেছেনই।,,,,,হযরত হামজা মদিনার ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হলেও পুঁথি রচয়িতা তাঁকে শতায়ু প্রদান করেন। হযরত আলীর কল্পিত পুত্র মুহম্মদ হানিফের যুদ্ধ এবং  সোনাভান, জয়গুনবিবিতেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। 

সাত. অনেকে মনে করেন-এদেশের হিন্দুদের মিথলজির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে পুঁথি লেখকরা আরব থেকে পীর পয়গম্বর দিয়ে এরকম আজগুবি গল্প সাজিয়েন। কিন্তু তারা ভুলে গেছেন যে, ভারতের সনাতন ধর্মের মিথলজির চরিত্রগুলো স্থানীয়।  তিনি উদাহরণ দেন- " মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশিরাম দাম কহে শুনে পুন্যবান।"
পুঁথি লেখকরা পাল্টা লেখেন- " অধীন ফকির কহে কেতাবের বাত, যেবা শুনে বাড়ে তার বারেক হায়াত"। তথা লাখে লাখে সৈন্য চলে কাতারে কাতার, গনিয়া দেখিল মর্দ চল্লিশ হাজার। 

আট. বাঙালি মুসলমান মনে করে আরবি হল কোরানের ভাষা, নবীর ভাষা ও বেহেশত-দোজখের ভাষা।  তাই আরবি একমাত্র পবিত্র ভাষা। কিন্তু তারা জানতেন না ভাষা কখনও  কোনো ধর্মের হয় না। পুঁথি লেখকরাও পাঠকের মন বুঝে বাংলা-আরবি-ফারসি মিশ্রিত ভাষায় কবিতা লিখতেন।  মজার বিষয় হল, তুর্কি- আফগান-মোগল- সুলতান-নবাব  নামীয় শাসকরা  আরবি নয়, ফারসি ভাষা দ্বারা শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। 

নয়. তিনি দেখিয়েছেন বাঙালি মুসলমান দ্বারা বড় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়নি। উত্তর ভারত থেকে স্যার সৈয়দ আহমেদ কলিকাতায় আলিগড় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

দশ. স্থানীয় মুসলমানেরা বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন করেছিল তা ছিল - উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের আন্দোলন এবং অগ্রগতির সম্প্রসারণ মাত্র। উল্লেখ্য যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে তখন অভিজাত হিন্দুরা সে সুযোগটা  কাজে লাগায়। তারা প্রথমে ইংরেজি ভাষা রপ্ত করে। গড়ে তোলেন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অথচ সে সময় কলিকাতায় প্রায় চল্লিশ ভাগ মুসলমানের বাস ছিল। 

এগার. তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' উপন্যাস সম্পর্কে বলেছেন- এ উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষের জীবন-যাত্রা সঠিকভাবে ফুটে উঠেছে। হোসেন আলীর চরিত্রটি হলো রিয়েল বাঙালি মুসলমানের চরিত্র। 

বার. তিনি রাসেল, দস্তয়েভস্কি ছাড়াও বাংলার চিত্র শিল্পী জয়নুল আবেদিন ও  এসএম সুলতান সম্পর্কে নির্মোহ আলোচনা করেছেন। জয়নুল আবেদীন ও সুলতানের চিত্র শিল্পে এদেশের কৃষক ও তাদের  উৎপাদন উপকরণ চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। ভবিষ্যতের ভাবনা ও বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে নিরপেক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা করেছেন- যা বুদ্ধিজীবী মহলে এখনও সমাদৃত। 

তের.  তিনি মনে করেন, কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি জসিমউদ্দীনের  পিছনে যদি উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা অথবা অভিজাত হিন্দুরা  না থাকতেন, তাহলে তাঁরা কবি হিসেবে  প্রতিষ্ঠা পেতেন না। এ বিষয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কারণ তাদের নিয়ে তৎকালীন মুসলিম সমাজের বিরোধিতা ইতিহাসসিদ্ধ। তিনি দুঃখ করে বলেছেন- 'এদেশের বাঙালি মুসলমানেরা ঠিক এভাবে একবার চুলা থেকে খোলায়, আবার খোলা থেকে চুলায়  পড়েছে'।  তারা পুর্বে তাদের দুর্দশার জন্য জন্য উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের দায়ী করতো; এখন দায়ী  করছে বেদ্বীন-নাসারাদের। 

চৌদ্দ.  তাঁর শেষ প্রবন্ধ হল ' একটি প্রাতিস্বিক গ্রন্থ'। এটি হল ফরহাদ মজহারকে নিয়ে( তিনি বানানটি এভাবেই লিখেছেন)। তাঁর মতে কবি ফরহাদ মজহার বাংলার এমন একটি প্রতিভা, যা আগামীতে বহু পুরস্কারে ভূষিত হবেন। ফরহাদ মজহারের 'প্রস্তাব' গ্রন্থের প্রশংসা করতে গিয়ে ফরহাদ মজহারের বেশ কয়েকটি উক্তির  উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ফরহাদ মজহার বলেছেন- বাংলাদেশের যুদ্ধকে মার্কস ও লেলিনের নামে  আমাদের প্রিয় বন্ধুরা অনেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁরা বাংলাদেশের জাতি সত্তাকে স্বীকার করতে চাননি এবং যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরা পঁচিশে মার্চের আন্দোলন এবং সেনাবাহিনীর বর্বরতাকে বাস্তব থেকে বিচ্যুত করে বিমূর্ত বিতন্ডা চর্চার বিষয় করে ফেলেছিলেন। অবাস্তব আর কিম্ভূত বিতন্ডা।,,,,,,ইতোমধ্যে পথের উপর মানুষের শরীর আর রক্ত জলকাদায় লেপ্টে অঙ্কুরোদগমের প্রার্থনায় বীজ হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের ভাষায় সেই বীজকে বাঙালি বলে "। ফরহাদ মজহার তাঁর প্রবন্ধে বারবার  শুধু 'বাঙালি' শব্দ ব্যবহার করেছেন। আহমদ ছফার সৌভাগ্য যে, তিনি জীবদ্দশায় ফরহাদ মজহারের মতিভ্রম দেখে যেতে পারেন নি। রেনেসাঁস পুর্ববর্তী কবি-সাহিত্যিকদের কাজ ছিল পরম সত্তাকে নিবেদন করে তাদের সমুদয় সাহিত্য কর্ম পরিচালনা করা। যেহেতু মানুষের মন অসম্ভব চঞ্চল। সে ইচ্ছাধীন থাকতে চায়। সেজন্য সমস্ত পাপবোধ থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র পথ হলো নিজ নিজ ঈশ্বরের কাছে নিজেকে  সমর্পন করা। আর  রেনেসাঁস পরবর্তী জীবন  হলো ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য আর চিন্তার স্বাধীনতা। মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো হয়ত চর্বিত চর্বন, নয়তো ধর্মীয় পুনজাগরণ। কিন্তু লেখক ভাবেন নি- কবি নজরুল আর উন্মাদ নজরুল এক নন। তেমনি ভাবেন নি, তাঁর প্রিয় শিষ্য ফরহাদ একসময় উন্মাদ হয়ে যাবেন। 

লেখক : গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার ও গণতন্ত্রায়ন  বিষয়ক গবেষক।

এই বিভাগের আরো সংবাদ